নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)
------------
★ মানসী মন্ডল ★
ইসসস একটুর জন্য বাসটা মিস হয়ে গেল! খুব বিরক্তির সঙ্গে একবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো মণি।
আর দু'মিনিট আগে ক্লাস থেকে বেরোলে তার এই অবস্থা হত না। কলেজ থেকে সময়ে ফিরবার এটাই ছিল তার লাস্ট বাস। আচমকা বৃষ্টি এসে সব মাটী করে দিল।
ধূর ভাল্লাগে না। বলেই সে একরাশ মনখারাপ নিয়ে ভেজা চুড়িদার আর মাথাটা একবার ঝেড়ে নিলো। তারপর বাসস্ট্যান্ডের একটা বড় গাছের তলায় গিয়ে চুপ করে বসলো। আবার কখন বাস কে জানে! হঠাৎ ডান চোখের পাতাটা কাঁপতেই তার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। খিদেও পেয়েছে খুব। বিকাল পাঁচটা পেরিয়ে গেছে। কখন সকাল নটায় দুটো খেয়ে কলেজ এসেছে। কাছে বাস ভাড়া বাদে বাড়তি টাকাও নেই যে কিছু কিনে খাবে। অগত্যা সহ্য আর অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই দেখে সে ব্যাগ থেকে নোটস গুলো বের করে চোখ বোলাতে লাগলো।
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan |
মণি অজ পাড়াগাঁয়ের অতি সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারের মেয়ে। বৈভব বলে তার কিছুই নেই। গ্রামের পড়া অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য বহুদিন ধরেই তাকে বাইরে অনেক দূরে আসতে হয়। বাবার ইচ্ছে আর তার অদম্য জেদের জন্যই পড়াশুনাকে আজও টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। নইলে কবেই বাপের ভাত ছেড়ে শ্বশুরের ভাত খাওয়া শুরু হয়ে যেত। মণির মা মেয়েদের ভাল মন্দ খুব একটা বোঝে না, আর সে নিয়ে মাথাও ঘামায় না। সংসারে পনেরো জন সদস্যের মধ্যে সে সাধারণ ভাবেই বেড়ে উঠছিল। নেহাত পড়াশোনায় ভাল তাই অনেকের সাহায্যে আজ কলেজের দোরগোড়ায় এসে পড়েছে।
গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে সে এসে যখন পৌঁছালো তখন প্রায় আটটা বাজে। আটটা মানে গ্রামের রাস্তা শুনশান। কিন্তু আজ একটু বেশিই নিঃস্তব্ধ লাগছে। মনটা কেমন করে উঠলো সঙ্গে একটু ভয়ও পেলো। অন্য সময় বন্ধুদের বাড়ী থেকে যখন নোট নিয়ে ফেরে তখনও তো কই এতটা চুপচাপ থাকে না রাস্তাঘাট! কিন্তু আজ এমন কেন লাগছে! যেন কোনও যাদুবলে সারাগ্রামের প্রাণবায়ু টেনে বের করে নিয়েছে কেউ। বৃষ্টি তখনও টিপ টিপ করে পড়ে চলেছে। কাছে ছাতা না থাকায় মণি বেশ ভালই ভিজে গেল এবং হাওয়াতে কেমন শীতও অনুভব করলো। বাড়ী থেকে বাসস্ট্যান্ড বেশ খানিকটা দূর। অন্ধকার ঘুটঘুটে রাস্তা। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন আর সেই আলোয় সে রাস্তা দেখে দেখে হাঁটছিল। হঠাৎ দেখলো বেশ কিছুটা দূরে একটা ক্ষীণ আলো। সে সেটা লক্ষ্য করে যত এগোতে লাগলো আলোও তার দিকে তত এগিয়ে আসতে লাগলো। এতক্ষণে সে বুকে একটু বল পেলো, কেননা এ আলো তার চেনা। বহুদিন এমন হয়েছে, সে ফিরতে দেরী করলে একটি হ্যারিকেনের আলো তারজন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে।
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan |
কাছে আসতেই চেনা গলার আওয়াজ টা সে পেলো।
তোর কী কোনও আক্কেল নেই? এত রাত হয়েছে হুঁশ থাকে না! তোর বাবা এখনও ফেরেনি।ফিরলে কী জবাব দিতাম?
বইয়ের ব্যাগটা মণি হ্যান্ড ওভার করে বলল-- আঃ চুপ করো তো মা। রোজ রোজ একই কথা শুনতে ভাল্লাগে না। তাছাড়া আমি যে বেড়াতে যাইনা বা হাওয়া খেতে যাই না সেটা তো তোমরা জানো। খিদের জ্বালায় মনির গলাটা বেশ কর্কশ শোনালো।
মা ধমক দিয়ে বলল -- আস্তে কথা বল। গ্রামে আজ কতবড় বিপদ ঘটেছে জানিস! আইবুড়ো মেয়ে রাত অবদি বাড়ীর বাইরে থাকলে মা বাবার কত দুশ্চিন্তা হয় তুই কী জানবি! বড় হ, মা হ তখন বুঝবি।
-- কী হয়েছে মা? এত চুপচাপ পরিবেশ?
মা বলল আগে বাড়ী চল তারপর জানবি কী হয়েছে।
একহাঁটু কাদাজল পেড়িয়ে মা মেয়ে মুখে কথাটি না বলে খুব সন্তর্পণে বাড়ী ঢুকলো।
ঝড়বৃষ্টির জন্য কারেন্ট নেই। অন্ধকারেই যাবতীয় কাজ সারতে হচ্ছে। মুড়ি খেতে খেতে মণি মা কাকীমার মুখে সেই বিপদের কথা শুনলো। গ্রামে বাইরে থেকে লোক ঢুকে বোমাবাজি করে বেশ কিছু মানুষের জীবননাশ করে চলে গেছে। সারা গ্রামে কার্ফু জারি হয়েছে। কেউ বাড়ী থেকে বেরোতে পাবে না বিনা কারণে। সারা গ্রামটা পুলিশ, মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। কী এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। মণিরও কলেজ যাওয়া আপাতত স্থগিত রইলো। মনে মনে সে যতটা না আতঙ্কিত হল তার থেকেও বেশি তার রাগ হল। কোত্থেকে এসে সব রাজনীতি করে চলে যাবে আর সাফার করবে সাধারণ মানুষ। বাড়ীর বড়রা বেশ করে ছোটদের ধমক ধামক দিয়ে বাড়ীর বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিল।
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan |
গ্রামের চারপাশে ফৌজদারী টহল চলতে লাগলো। পরিস্থিতি এখন অনেক স্থিতিশীল। মণি তার নিজের মতো করে আবার পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। ভাই বোন গুলোও তার তালে তাল মিলিয়ে চলছে। অভাবী পরিবারে স্বপ্ন দেখা বারণ। তাই সে আর তার ভাইবোনেরা জীবনটাকে শুধু খেয়ে পড়ে টিকিয়ে রেখে কোনওরকমে পড়াশোনাটা চালিয়ে যায়। অনেকবার অনেক বিয়ের সম্বন্ধও আসে কিন্তু সে না করে দেয়। বাবাও সে ভাবে জোর দিয়ে কিছু বলে না। জানে তো বিয়ে দিতে গেলেও অনেক খরচা। সেটুকু বহন করার মত ক্ষমতা মণির বাবার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবাদের দ্বারা হয়ে ওঠে না। তবুও তারমধ্যেই নদীর জলের ধারার মতো বয়ে চলে যায় জীবন, কোথাও কোনও আঘাতের বিনিময়ে থেমে থাকে না।
পুজোর মাস এলো। দেখতে দেখতে পুজোও চলে এলো সামনে। আর যত বাধা বিপত্তিই থাকুক না কেন, পুজোতো পুজোই হয়! তার আনন্দও অনাবিল। মণির পুজো বলে আলাদা কিছু নেই, তবুও চারপাশের পরিবেশটা দেখে তার মনেও পুলক জেগে ওঠে। বর্ষার জলে আকাশটা ধূয়ে মুছে কেউ যেন নির্মল করে দিয়েছে। ভোরবেলা উঠোনের পাশে শিউলি গাছটার তলাটা দেখে তারও কেমন পুজো পুজো ঘোর লাগে। শিউলির গন্ধে মনটা মাতোয়ারা হয়ে যায়। মণি বরাবরই খুব ভাবুক প্রকৃতির। রোমান্টিসিজম তার মানসিকতার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাস্তায় হাঁটতে চলতে অহেতুক সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। পুজোর কটা দিন আগে রোজগারের উদ্দেশ্যে যারা ভাদু গান গাইতে আসে বাড়ী বাড়ী তাদেরকে সে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। ভাদুর কাহিনী শুনতে গিয়ে অহেতুকই তার দুঃখে একাত্ম হয়ে চোখে জল আসে। অনেকে এসব দেখে শুনে তাকে স্নেহ করে পাগলী বলে। শুধু বাপের কড়া শাসন তাকে কল্পনার রাজ্য থেকে স্বাভাবিক বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনে।সবসময়ই খুব হাসিখুশি থাকে, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎই তার চোখে শোকের গভীর ছায়া নেমে আসে। তার চোখের দিকে চাইলেই মনটা পড়ে ফেলা যায়।
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan |
পুজোর দিন সমাগত। ভাইবোন বন্ধু বান্ধব নিয়ে মণিও বেশ মাতোয়ারা। আর এই পুজোই মণির জীবনের মোর এক ঝটকায় বিপরীত মুখে বাইয়ে দিল। এই পুজোমন্ডপেই একদিন চোখাচোখি হল নীলের সাথে। গ্রামের কে কোথায় এলো গেলো এ নিয়ে তার কোনওকালে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। বড্ড ছেলেমানুষী মেয়েটার মধ্যে। তবুও ঐ দুটো চোখ তাকে বিশেষ ভাবে কৌতুহলী আর জিজ্ঞাসু করে তুলল।
সে যেখানে যাই করে বারবার ঘুরে ফিরে সেই মানুষটাকেই খোঁজে আর তার সেই চোখদুটো। কেননা মণি দেখেছে যতবারই চোখদুটো খুঁজেছে ততবারই ঐ চোখ দুটো তার দিকেই চেয়ে আছে। আর পুজো পরিবেশে এরকম একটা ঘটনায় মণি বেশ পুলকিত হয়ে আবেগী হয়ে পড়লো।
মণি খোঁজ লাগালে কে ঐ অপরিচিত! কোত্থেকে এসেছে! এখানেই বা কেন! কিন্তু এতসব প্রশ্নের উত্তর তাকে কে দেবে?
আরও পড়ুন:- সতীপনা দেখে আর হেসে বাঁচিনা। কত রেট ?
এভাবেই আরও কিছু দিন কেটে গেল চোখাচোখিতে। কেউ মুখে কিছু বলে না। অনেক খোঁজ নিয়ে জানলো ওর নাম নীল, এখানে আত্নীয়র বাড়ী এসেছে পুজো দেখতে। পুজো কেটে গেল, মণি পড়াশোনা জীবনে ফিরে গেল। আর নীল! তা খবরও আর রাখার সুযোগ বা তাগিদ কোনওটাই হয়নি। আস্তে আস্তে বাতাসে শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়লো। শীতকাল মণির মোটেও পছন্দ না, কেননা শীতে তার নানারকম শারীরিক সমস্যা হয়। একদিন সে কলেজ থেকে ফিরছে, হঠাৎ দেখে রাস্তায় সেই ছেলেটি। বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। অবাক করে দিয়ে ছেলেটি হেসে ওর রাস্তা আগলে সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমটা অবাক হল তারপর ঘোর কাটিয়ে মণি একটু মুচকি হাসলো।
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan |
নীল সোজা চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন?
মণি বড় বড় চোখ করে নীলের দিকে চেয়ে রইলে। কারণ এর আগে কেউ কখনও ওকে আপনি আজ্ঞে করে কথা বলেনি।হেসে বলল-- ভালো। আপনি কেমন আছেন?
ভালই আছি। আপনার কলেজ হয়ে গেল?
হুম। এইতো বাড়ী যাচ্ছি। আপনি কবে এলেন?
এই তো কাল। এসে থেকে আপনাকেই খুঁজছি।
আমাকে! মণির বিস্ময়ের অন্ত রইলো না।
হুম। আপনি এত পড়াশোনায় ভাল, আপনাকে খোঁজাটা কী খুব অপরাধের!
না না তা নয়। তবে আমি পড়াশোনায় কেমন আপনি কেমন করে জানলেন?
আমি আপনার জন্ম তারিখটাও জানি,আর আপনার গুনাবলী জানব না?
মণির যেনো অবাক হওয়ার সীমা পরিসীমা থাকলো না। ছোট করে অস্ফুট একটা উত্তর সে দিল- -" ও"।
এই বলে কিছুটা অন্য মনস্ক হয়ে সে এগোতে থাকে একপা একপা করে,
নীল চলে যায় বাসস্ট্যান্ডের দিকে আর মণি বাড়ীর দিকে।
সারাদিন একই কথা বারবার ভাবতে ভাবতে মণি শুধু অন্য মনস্ক হয়ে যায়,কখনও আবার আপন মনে হাসে।বাড়ীর বড়দের কাছে এজন্য বকাও খায়। বন্ধু বান্ধবরাও দূর চলে যায় ওর চুপচাপ থাকার কারণে। কোনও একটা ভাললাগার আবেশ তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে। এমনি করে আবার কটা দিন কেটে যায়। আবার একদিন বিকালের দিকে নীলের সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে যায়। দুজনেই হাওয়া খাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ছিল রাস্তায়। তবে উদ্দেশ্য কোনটা মুখ্য ছিল আর কোনটা গৌন্য বোঝা মুশকিল। এদিনও নীল মণিকে ডেকে বলে-- এই যে শুনছেন? একটু শুনুন।
নীলমণি ( ১ ম পর্ব)। nilmoni golpobitan |
গলার শব্দে মণির বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। এই একটা জিনিস সে বুঝতে পারে না ও সামনে এলে মণির কেন এমন হয়। ফস করে একটা পিঠ ব্যাগ সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে -- ধরুন এটা।
কী এটা? অবাক হয়ে মণি জানতে চায়।
আরে ধরুনই না। অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জন্মদিন তো চলে গেল,আমাকে একবার খেতে বললেনও না। তাই আমিই দিচ্ছি।
হাত বাড়িয়ে মণি ব্যাগটা নেয়। নীলের চোখে চোখ রাখতে পারে না। এই তার এক জ্বালা। মুখ নামিয়ে বলে" আমার আবার জন্মদিন। " আর দু একটা কথা বলে ওরা যে যার স্থানে ফিরে যায়। খুব একটা কথা তারা বলতো না। গ্রামের লোক কে কী বলবে এই ভয়ে দুজনেই সতর্ক ছিল। মণি বাড়ী ফিরে দেখলো ব্যাগে কিছু টুকটাক খাবার জিনিস। মনটা বেশ চঞ্চল হয়ে উঠলো। আরও কিছু পাবার আশায় সে ব্যাগের প্রতিটি খাপ ভাল করে খুঁজে দেখলো। শেষে হতাশ হয়ে মন খারাপ করে বসে থাকলো। মা বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে কিন্তু কী হয়েছে সেটা বোঝার ক্ষমতা মণির মায়ের ছিল না। কেননা সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্তানের খুঁটিনাটি নজরে রাখা তার পক্ষে একটু কঠিন ছিল।
কয়েকদিন পর মণি নীলকে ব্যাগটি ফেরত দিতে গেল। আর তখনই মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে ঘটিয়ে ফেললো তার কল্পনার অতীত কান্ডটি।............ ক্রমশ
লেখিকাঃ মানসী মন্ডল
চিত্রঃ সংগৃহীত
➥ আপনার লেখা কবিতা, গল্প ও আপনার এলাকার যে কোনো রকম খবর প্রকাশের জন্য whatsapp এ যোগাযোগ করুন 8769038178 নাম্বারে➥
কোন মন্তব্য নেই